জলবায়ু নিয়ে যেসব গবেষণা ঘুম হারাম করে দিচ্ছে !

জলবায়ু নিয়ে যেসব গবেষণা ঘুম হারাম করে দিচ্ছে !



ইউরোপীয় ইউনিয়নের কোপার্নিকাস ক্লাইমেট চেঞ্জ সার্ভিস (সিথ্রিএস) বুকে কাঁপন ধরানোর মতো তথ্য দিয়েছে। সংস্থাটি বলছে, ২০২৪ সালে, অর্থাৎ মাত্রই শেষ হয়েছে যে বছর, সেই বছরে বায়ুমন্ডলে কার্বন ডাই অক্সাইডের ঘনত্ব প্রতি মিলিয়নে ৪২২ অংশে পৌঁছেছে, যা সর্বোচ্চ রেকর্ড।

এমন একটি হাড় হিম করা খবর পরিবেশ ও জলবায়ুকর্মীদের ঘুম হারাম করে দিয়েছে। ফলে, জলবায়ু পরিবর্তন রোধে যেসব নীতিনির্ধারক কাজ করেন, তাঁদের ওপর চাপ বাড়ছে।

এ বিষয়ে ২০২১ সালে বিশ্বের বিজ্ঞানীরা একটি ঐকমত্যপত্র প্রকাশ করেছিলেন। সেখানে বিজ্ঞানীরা বলেছেন, বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ও এর প্রভাবগুলো অপ্রত্যাশিত বেগে প্রকাশিত হচ্ছে। পরিবেশ নিয়ে এখনই আমাদের সর্বোচ্চ সতর্ক হওয়া প্রয়োজন।

কিছু জটিল বিষয়
বিজ্ঞানীরা বলছেন, সারা বিশ্বের গড় তাপমাত্রা এরই মধ্যে প্রাক শিল্প যুগের তাপমাত্রার চেয়ে ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের চেয়ে বেশি মাত্রায় পৌঁছেছে। সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, এই বিপজ্জনক সীমা থেকে তাপমাত্রা নামছে না। এটি অপরিবর্তিত থাকলে জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি চরম আকার ধারণ করবে।

অ্যান্টার্কটিক বরফের কেন্দ্রে আটকে থাকা ২ হাজার বছরের পুরোনো বায়ুমন্ডলীয় গ্যাস বিশ্লেষণ করে একদল গবেষক গত নভেম্বরে এই উদ্বেগের কথা জানান। তাঁরা বলেছেন, ১৮৫০ থেকে ১৯০০ সালের গড় তাপমাত্রার সঙ্গে বর্তমান সময়ের গড় তাপমাত্রা তুলনা করে আমরা দেখতে পেয়েছি, বিশ্ব এখন ১ দশমিক ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় ভুগছে।

আর্কটিক তুন্দ্রাআর্কটিক তুন্দ্রা। ছবি: রয়টার্সনেচার জিওসায়েন্স জার্নালে প্রকাশিত গবেষণাপত্রে বিজ্ঞানীরা আরও বলেছেন, ১৩ শতক থেকে ১৭ শতকের তাপমাত্রার তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ২০২৩ সালে তাপমাত্রা বৃদ্ধির হার ১ দশমিক ৪৯ ডিগ্রি সেলসিয়াসে পৌঁছেছিল।

বদলে গেছে সমুদ্র
আটলান্টিকের উষ্ণতা বাড়া নিয়েও গভীরভাবে উদ্বিগ্ন বিজ্ঞানীরা। তাঁরা বলছেন, এভাবে উষ্ণতা বাড়লে সমুদ্র স্রোতের চিরাচরিত পানিব্যবস্থা ব্যহত হবে।

আটলান্টিক মহাসাগরের পানিব্যবস্থার নাম আটলান্টিক মেরিডিয়োনাল ওভারটার্নিং সার্কুলেশন (এএমওসি)। এই ব্যবস্থার মাধ্যমে গ্রীষ্মমন্ডলীয় অঞ্চল থেকে উত্তর আটলান্টিকে উষ্ণ পানি প্রবাহিত করা হয়। ইউরোপের শীতকালকে হালকা রাখতে শত শত বছর ধরে এই ব্যবস্থা কাজে লাগানো হচ্ছে।

কিন্তু ২০১৮ সালের এক গবেষণা বলছে, আটলান্টিকের পানি ব্যবস্থার এই পদ্ধতিটি (এএমওসি) ১৯৫০ সালের পর প্রায় ১৫ শতাংশ দুর্বল হয়ে পড়েছে।

এরপর ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে সায়েন্স অ্যাডভান্সেস জার্নালে প্রকাশিত গবেষণায় বলা হয়েছে, এএমওসি পদ্ধতিটি যতটা দুর্বল হয়েছে বলে মনে করা হয়, প্রকৃত অবস্থা তারচেয়েও গুরুতর।

চরমভাবাপন্ন আবহাওয়া
আটলান্টিকের উষ্ণতা বাড়ার কারণে সামুদ্রিক ঝড়ের তীব্রতাও বাড়ছে। কিছু ঝড় কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই ক্যাটাগরি ১ থেকে ক্যাটাগরি ৩–এর ঝড়ে পরিণত হচ্ছে। এই প্রবণতা শুধু আটলান্টিকের ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ নেই, বরং অন্যান্য সমুদ্রের ক্ষেত্রেও ঘটছে।

২০২৪ সালের অক্টোবরে মেক্সিকো উপসাগরের গ্রীষ্মমন্ডলীয় ঝড় মাত্র এক দিনের ব্যবধানে শক্তিশালী হারিকেন মিল্টনে রূপ নিয়েছিল। ওই হারিকেন ফ্লোরিডার পশ্চিম উপকূলকে তছনছ করে দিয়েছিল।

উষ্ণ বাতাস অনেক বেশি আর্দ্রতা ধরে রাখতে পারে, যার কারণে তীব্র ঝড় ও ভারী বৃষ্টিপাত হয়। ঠিক এই কারণেই ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে হারিকেন হেলেন যুক্তরাষ্ট্রের নর্থ ক্যারোলাইনায় আঘাত করেছিল এবং ভারী বৃষ্টিতে বন্যা সৃষ্টি হয়ে শত শত বাড়ি ভেসে গিয়েছিল।

বন ও দাবানল
বৈশ্বিক উষ্ণতার কারণে পৃথিবীর জলপথগুলোও শুকিয়ে যাচ্ছে। বন থেকে হারিয়ে যাচ্ছে আর্দ্রতা। ফলে পশ্চিম আমেরিকা থেকে কানাডা এবং দক্ষিণ ইউরোপ থেকে রাশিয়া হয়ে দূরপ্রাচ্য পর্যন্ত প্রায়ই দেখা দিচ্ছে ভয়ঙ্কর দাবানল। 

দাবানলের কারণে বাড়ছে বৈশ্বিক উষ্ণতাদাবানলের কারণে বাড়ছে বৈশ্বিক উষ্ণতা। ছবি: রয়টার্সগত বছরের অক্টোবরে নেচার ক্লাইমেট চেঞ্জে প্রকাশিত গবেষণাপ্রবন্ধে বলা হয়েছে, ১৯৫০ সালে রেকর্ড শুরু হওয়ার পর থেকে ২০২৪ সালে ব্রাজিলের আমাজন বন সবচেয়ে খারাপ অবস্থার মধ্যে পড়েছে। এই সময়ে সবচেয়ে বিপজ্জনক খরার কবলেও পড়েছে ব্রাজিল। গত বছর দাবানলের কারণে ব্রাজিলে নদীগুলোর পানির স্তর সর্বনিম্নে পৌঁছে গেছে।

গত বছরের শুরুর দিকে অপর এক গবেষণায় বিজ্ঞানীরা উদ্বেগ জানিয়ে বলেছেন, ২০৫০ সালের মধ্যে আমাজনের ১০ থেকে ৪৭ শতাংশ তীব্র তাপমাত্রা ও খরার কবলে পড়তে পারে। এই উষ্ণায়ন আমাজনকে চরম বিপর্যয়ের মুখে ফেলে দেবে। তখন আমাজনের গাছগুলো আর পর্যাপ্ত আর্দ্রতা উৎপাদন করতে পারবে না। ফলে বাস্তুতন্ত্র ক্ষয়ে যাবে এবং আমাজন এক বালুকাময় এলাকায় পরিণত হতে পারে।

সারা বিশ্বের বনাঞ্চলই বেঁচে থাকার জন্য তীব্র সংগ্রাম করছে। গত বছরের জুলাইয়ের এক গবেষণা বলছে, বনাঞ্চলগুলো সামগ্রিকভাবে আগের বছরগুলোর মতো কার্বন ডাই অক্সাইড শোষণ করতে পারছে না। এর পেছনে একমাত্র কারণ—দাবানল ও খরা। আর বনগুলো যেহেতু কার্বন ডাই অক্সাইড শোষণ করতে পারছে না, তাই রেকর্ড পরিমাণে কার্বন ডাই অক্সাইড  বায়ুমন্ডলে প্রবেশ করছে।

আটলান্টিক মহাসাগরে হাজার হাজার বছর ধরে বিশাল বিশাল আর্কটিক তুন্দ্রা (সবচেয়ে ঠান্ডা জৈববস্তু) রয়েছে। এসবের কাজ মূলত বায়ুমন্ডলের কার্বন শোষণ করা। কিন্তু ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে যুক্তরাষ্ট্রের একদল সমুদ্রবিজ্ঞানী আবিষ্কার করেন, দাবানলের কারণে তুন্দ্রাগুলো আর আগের মতো কার্বন শোষণ করতে পারছে না।

আগ্নেয়গিরির ঢেউ
বিজ্ঞানীরা আশঙ্কা করছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত ভয়াবহ মাত্রায় বেড়ে যেতে পারে। আইসল্যান্ডে অতিদ্রুত হিমবাহ গলে যাচ্ছে। এতে ম্যাগমা জলাধারগুলো অস্থিতিশীল হয়ে উঠতে পারে বলে মনে করছেন আগ্নেয়গিরি বিশেষজ্ঞরা। তাঁরা বলছেন, যেভাবে হিমবাহ গলছে, তাতে আরও অনেক ম্যাগমা তৈরি হবে, যা ভূগর্ভস্থ চাপ তৈরি করবে।

তথ্যসূত্র: রয়টার্স, গার্ডিয়ান, ডয়চে ভেলে ও নাসা আর্থ অবজার্ভেটরি



Previous Post Next Post